
চাঁদপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়া গ্রামের ২৮ বছর বয়সী শিল্পীর জীবন একসময় ছিল অনিশ্চয়তা আর ভয় দিয়ে ঘেরা। স্বামী ছেড়ে চলে গেছেন, দুই সন্তানের দায়িত্ব একাই সামলাতে হয়েছে। সংসার চালানোর কোনো নিশ্চিত পথ ছিল না। কিন্তু আজ সেই শিল্পী আর আগের মতো নন। উঠোনে হাঁসের ডাক, খাঁচায় মুরগির কোলাহল—এসবই এখন তাঁর নিজের আয়ের উৎস, নিজের শক্তির পরিচয়। শিল্পীর মতোই কুমিল্লার লাকসামের মহিষাতুয়া গ্রামের ২৯ বছর বয়সী সেলিনার গল্পও সংগ্রামের। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর সন্তান হারানোর শোক নিয়েই থেমে যাননি তিনি। হাতে তৈরি বেতের নামাজের পাটি বানিয়ে বিক্রি করছেন, পাশাপাশি দক্ষতা প্রশিক্ষণ নিয়ে গার্মেন্টসে কাজের স্বপ্ন দেখছেন। শিল্পী কিংবা সেলিনা একা নন। তাঁদের মতো হাজারো অতিদরিদ্র, স্বামীপরিত্যক্ত, তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারী নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ পেয়েছেন ‘স্বপ্ন’ (স্ট্রেংদেনিং উইমেন্স অ্যাবিলিটি ফর প্রোডাকটিভ নিউ অপরচুনিটিজ) প্রকল্পের মাধ্যমে। আয়ের পথ খুলছে, ফিরছে নিরাপত্তা স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), সুইডিশ সরকারের সহযোগিতা ও মেরিকোর আর্থিক সহায়তায় জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬ মেয়াদে ১২টি জেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে এই প্রকল্প। লক্ষ্য একটাই—অতিদরিদ্র নারী–প্রধান পরিবারগুলোকে টেকসই আয়ের পথে দাঁড় করানো। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ১৮৮ নারীকে উৎপাদনমুখী কাজে যুক্ত করে ৭৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা মজুরি দেওয়া হয়েছে। প্রতিজন নারী গড়ে পেয়েছেন প্রায় ৭৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি সঞ্চয় স্কিমে যুক্ত হয়ে প্রত্যেকে গড়ে আরও ১৪ হাজার ১০০ টাকা জমাতে পেরেছেন। এই টাকাই বিনিয়োগ হচ্ছে গরু–ছাগল, হাঁস–মুরগি, সবজি চাষ বা ছোট ব্যবসায়। শিল্পী সমকালকে বলেন, “প্রথমে তিনটা মুরগি কিনছিলাম। পরে হাঁসও নিছি। কিছু মরছে, কিছু বিক্রি করছি। এখন আমার দেশি হাঁস আছে, চীনা হাঁস আছে। এইগুলোই আমার নিজের আয়।” এই আয় শুধু সংসার চালানোর উপায় নয়—এটি তাঁর আত্মবিশ্বাসের নাম। সেলিনা থেকে মনি—নিজ হাতে দাঁড়ানোর গল্প
কুমিল্লার সেলিনা মাসে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করেন নামাজের পাটি বানিয়ে। তাঁর ভাষায়, “আমার জীবন থেমে যায় নাই। কাজ শিখে আবার শুরু করছি।” শেরপুরের নকলা উপজেলার অষ্টধর গ্রামের মনি বেগমের গল্প আরও বিস্তৃত। স্বামী অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে সংসারের হাল ধরেন তিনি। ঢাকার গার্মেন্টসে সাত বছর কাজ করার পর অসুস্থতায় গ্রামে ফেরেন। এরপর বারবার ব্যর্থতার মুখে পড়েন। তখনই জানতে পারেন ‘স্বপ্ন'র বাণিজ্যিক হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগে শুরু করেন খামার। আজ তাঁর খামারে রয়েছে প্রায় ৫০০ হাঁস। মাসে আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, তিন নারীকে তিনি কাজও দিয়েছেন। মনি বলেন, “এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। সমাজেও সম্মান পাই। চাই, আমার মতো আরও নারীরা দাঁড়াক।” দক্ষতা, চাকরি ও ফলো-আপ
প্রকল্প অফিসার মোহাম্মদ মাসুম মিয়া জানালেন, জীবিকা-দক্ষতার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৬ হাজার ৫৩৮ নারী, শিল্প প্রশিক্ষণ (এসএমও) নিয়েছেন ২ হাজার ২০৮ নারী, এর মধ্যে ১৭১ জন ইতোমধ্যে চাকরিতে যুক্ত। আরও ৪৮৩ জন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন, সিএনআরএস–এর মাধ্যমে ৩২২ জন উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের আওতায় আসছেন। এক হাজার ১২০ নারী অ্যাপ্রেন্টিসশিপ প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত। তিনি জানান, চাঁদপুর-কুমিল্লায় প্রায় ২২০ নারীকে বাছাই করা হয়েছে গার্মেন্টস এবং শিল্প সেলাই মেশিন অপারেশনের মতো ফরমাল সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তিনটি ব্যাচে প্রশিক্ষণ চলছে কুমিল্লা বার্ড (বার্ড) এবং কুমিল্লা ইপিজেড–এর অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। মাসুম মিয়া বলেন, ‘আমরা শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই থেমে যাই না। ফলো-আপ করি। জব প্লেসমেন্টের জন্য পোশাক কারখানার সাথে আমাদের চুক্তি আছে। পরীক্ষার পর ওদের চাকরি হবে।’ তার মতে- 'স্বপ্ন' প্রকল্পের বড় শক্তি হলো ফলো-আপ সাপোর্ট। প্রশিক্ষণ শেষে নারীরা কীভাবে কাজ ধরছে, সেটি মুঠোফোনে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন ইউনিয়ন কর্মী, উপজেলা প্রজেক্ট অফিসার ও জেলা পর্যায়ের ফোকাল টিম। জলবায়ু-সহনশীল নতুন জীবিকা
জলবায়ু ঝুঁকির প্রভাব বৈশ্বিকভাবে বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রকল্পটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে জলবায়ু অভিযোজনুভিত্তিক জীবিকা। ৮ হাজার ৭১৬টি নারিকেল চারা রোপণ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহায়তায় ২৮৩টি জলবায়ু-সহনশীল জীবিকা প্রদর্শনী প্লট। এই প্লটগুলোতে শিখছেন নারী—খরা-সহনশীল ফসল চাষ, রোগ-বালাই প্রতিরোধ, বৃষ্টিনির্ভর চাষ ও জলুসাশ্রয়ী উৎপাদন পদ্ধতি। এছাড়াও, প্রকল্পের নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যুক্ত করা হয়েছে মাইক্রো-হেলথ ইন্স্যুরেন্স। ইতোমধ্যে ১০ হাজার ৩৭১ জন নারী বীমার আওতায় রয়েছে। ৭৮১টি সাধারণ দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ১১ জন ব্যক্তি মারা গেলে দ্রুত তাদের পরিবারের সদস্যর হাতে আর্থিক সুবিধা তুলে দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ২৫১ নারী টেলিমেডিসিন সেবা পেয়েছেন, দূরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে যে নারীরা পূর্বে বাড়িতেই চিকিৎসা করাতেন, তারা এখন মোবাইল ফোনে ডাক্তার পাচ্ছেন। পরিবারের প্রতিরোধ থেকে স্বনির্ভরতার পথে
প্রকল্পের শুরুতে অনেক পরিবারের আপত্তির কথা উল্লেখ করেন মাসুম মিয়া। তিনি বলেন, ‘চাঁদপুর-লাকসামে অনেক পরিবার মেয়েকে বাইরে যেতে দিতে চাইতো না। প্রবাসী পরিবার বেশি, সামাজিক রক্ষণশীলতা আছে। কিন্তু আমরা লিফলেট, মাইকিং, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধীরে ধীরে তাদের রাজি করিয়েছি।’ এমনকি অনেক নারী আগে ইউনিয়ন পরিষদেও যেতে সাহস করতেন না। কিন্তু এখন তারা- ইউএনও অফিসে গিয়ে কথা বলতে পারেন। জেলা প্রশাসকের সভায় বক্তব্য দিতে পারেন। কনফারেন্স রুমে অংশ নিতে পারেন। এই পরিবর্তন শুধু আয়ের কারণে নয়, এটি সামাজিক ক্ষমতায়নের বাস্তব রূপ। ‘স্বপ্ন’ কী বদলাচ্ছে
এটি শুধু একটি প্রকল্প নয়, একটি জেন্ডারভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো। চারটি স্তম্ভে এটির কাজ— জীবিকা উন্নয়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতায়ন। নারীর জীবনে নতুন আলো
চাঁদপুরের শিল্পী বললেন- ‘আমি নিজের পায়ে দাঁড়াইছি। এইটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’ আর সেলিনা চোখ ভেজা হাসিতে বললেন, ‘আমার জীবন তো থেমে যায় নাই। কাজ শিখে আমি আবার শুরু করছি।’ স্বপ্ন প্রকল্পের গল্প এটাই- এই দেশের গ্রামীণ অতিদরিদ্র নারীরা আর ‘অসহায়’ নয়। তারা উৎপাদনশীল, দক্ষ, আর্থিকভাবে স্বাধীন, এবং জলবায়ু-সহনশীল নতুন ভবিষ্যত গড়ে তুলছেন। প্রকল্পটি দেখিয়ে দিচ্ছে- যদি রাষ্ট্র, উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় সমাজ একসাথে এগিয়ে আসে, তাহলে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নারীরাও নিজেদের আলোয় জ্বলে উঠতে পারে। স্বপ্ন প্রকল্প বিষয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “স্বপ্ন প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক গ্রামীণ, পিছিয়ে পড়া নারী আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছেন। প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে তারা আরও বেশি স্বাবলম্বী হয়ে নিজেদেরকে শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।”
Read More