ভোর হলে হাঁসের কোলাহলে ঘুম ভাঙে শেরপুরের মনি বেগমের (৩৭)। ঘুমচোখে দ্রুত দরজা খুলে ছোট্ট ঘরের মেঝেতে চোখ পড়তেই দেখা যায় সারি সারি ডিম। ডিম সংগ্রহ দিয়েই শুরু হয় তাঁর দিনের কর্মযজ্ঞ।
শেরপুরের নকলা উপজেলার ধনাকুশা গ্রামে ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় মনি বেগমের ছোট এই খামারে এখন রয়েছে প্রায় ৫০০ হাঁস। প্রতিদিন ৯০-১০০টি ডিম সংগ্রহ করেন খামার থেকে। হাঁসের খাবার, ওষুধ ও খামারের অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা আয় হয় তাঁর।
মনি বেগমের মতো শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলায় অবহেলিত, তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী মারা যাওয়া ও স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া ৭৫৬ জন নারীর জীবনে স্বপ্ন ভাঙা থেকে স্বপ্ন গড়ার কাজ করছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে গরু-ছাগল পালন, ফুচকা তৈরি, দরজি, চা–দোকান, মুদিদোকান, কাঁথা সেলাই, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
২০০৫ সালে নকলা উপজেলার অষ্টধর গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে বিয়ে হয় মনি বেগমের। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু ২০১৩ সালে ভেঙে যায় সংসার। দুই সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। তখনই শুরু হয় তাঁর টিকে থাকার কঠিন লড়াই।
(Link to the news)
সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে মনির অন্য কোনো পথ ছিল না। তাই ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় রওনা দেন কাজের সন্ধানে। অনেক ঘুরে অবশেষে আশুলিয়ার জিরানী বাজারের একটি পোশাক কারখানার কোয়ালিটি বিভাগের সহকারী হিসেবে চাকরি পান। সাত বছর টানা আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন তিনি। নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন ঠিকই, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ২০২০ সালে ফিরে আসেন গ্রামে—ভাঙা স্বপ্ন, ক্লান্ত শরীর, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিছুটা সুস্থ হয়ে নতুন করে ভাবতে থাকেন, কী করবেন। ঠিক তখন জানতে পারেন, ইউএনডিপির ‘স্বপ্ন প্রকল্পের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’-তে জীবনদক্ষতা ও বাণিজ্যিক হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সুযোগটি হাতছাড়া করেননি তিনি। দুই দফায় ৯ দিনের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
চাকরির সঞ্চয় থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ইউএনডিপির সহায়তা ৫ হাজার টাকায় কেনেন ১০০টি ডিম পাড়া হাঁস। ভাইয়ের বাড়ির আঙিনায় বানিয়ে ফেলেন ছোট একটি খামার। ডিম বিক্রির লাভ থেকে আবার বিনিয়োগ করতে থাকেন। প্রতিদিন হাঁসের খাবার দেওয়া, পানি পরিবর্তন, সন্ধ্যায় ঘরে তোলা—সব কাজ একাই সামলান। এ পরিশ্রমই আজ তাঁকে স্বাবলম্বী করেছে। তাঁর বড় ছেলে এখন একটি কাজে যুক্ত হয়েছেন। মেয়েও স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। বসতভিটা না থাকলেও নিজের গল্প আর অর্জনে আজ তিনি গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, নিজের উপার্জনে চলতে পারলে পরিবারও সম্মান করে, সমাজও মূল্য দেয়। ছোট এই খামারকে বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চান তিনি। সমাজের অবহেলিত ও প্রতিবন্ধী নারীদের কাজের সুযোগ দিতে চান তাঁর খামারে।

মনির খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে আরও তিন নারীর। সবার জীবনেই ছিল দুঃখকষ্টের দীর্ঘ ইতিহাস। তাঁদের একজন লাকি আক্তার (২৫)। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। এখন এই খামারের কাজে তাঁর দিন বদলাতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘এই কাজের আয় দিয়ে বাচ্চাদের পড়াতে পারছি। তিন বেলার খাবার নিয়েও আর চিন্তা থাকে না।’
ইউএনডিপির জামালপুর ও শেরপুর জেলার প্রতিনিধি মো. আমির আলী বলেন, ইউএনডিপির মাধ্যমে দুই উপজেলায় ৭৫৬ জন অসহায় নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। নানা কাজে তাঁরা কেবল আয় করতেই শিখছেন না, মানসিকভাবেও এগিয়ে যাচ্ছেন।
